এবারে খুঁজে বের করেছি বউয়ের প্রকারভেদ:
১. লক্ষ্মী বউ: আবহমান বাংলার চিরায়ত আদর্শ বউ আমাদের লক্ষ্মী বউ। এই বউ সুকুমার রায়ের ছড়ার সাপের মতোই: “করে নাকো ফোঁস ফাঁস, মারে নাকো ঢুঁশ ঢাঁশ, নেই কোনো উৎপাত, খায় শুধু দুধ ভাত!” লক্ষ্মী বউ অল্পতেই খুশি। জামাইয়ের কাছ থেকে তার কোনো বাড়তি ডিমান্ড নেই। সারাদিন বাসার টুকটাক কাজ করবে, ড্রয়িংরুম বেডরুম বারবার গোছাবে, গেস্ট আসলে হাসিমুখে তাদের আপ্যায়ন করবে, কাজের লোককে দিয়ে না করিয়ে অনেক কাজ নিজেই করে ফেলবে, রান্নাঘরে তার দক্ষতার ছাপ রাখবে এবং পরিশেষে স্বামীকে ব্যাপক ভালোবাসবে। লক্ষ্মী বউ দুর্লভ প্রজাতির, এদের দেখা আজকাল শুধু পুরনো বাংলা ছবি বা নাটকেই পাওয়া যায়।
২. রাগী বা মেজাজী বউ: খ্যাঁচখ্যাঁচ, খিটপিট, কটমট শব্দগুলো এই বউয়ের জন্যই তৈরি হয়েছিল। সকালে উঠেই কাজের মহিলার সাথে খ্যাঁচখ্যাঁচ, এরপর বাচ্চাকে নিয়ে স্কুলে যেতে যেতে রিকশাওয়ালার সাথে এক প্রস্থ, স্কুল থেকে ফিরে আসার সময় হালকা বাজার সদাই করতে গিয়ে দোকানদারকেও একচোট। বাসায় ঢুকে বাচ্চাদের পড়াতে বসে তাদের ওপর দিয়েও সিডর বওয়াবেন রাগী বউ। দিনের শেষ ডোজটা বরাদ্দ জামাইয়ের জন্য, বাসায় ঢোকামাত্রই:
“কারেন্টের বিল দেয়া হয় না কয় মাস হুঁশ আছে?”
“সারাদিনতো বাসায় থাক না, আমার ওপর দিয়ে কি যায় বোঝো?”
“তোমার মা! উফফ্! অসহ্য একটা মহিলা!!”
“তাহলে আগে বলে দিলেই পারতে! ১৪ বছর সংসার করতে গেলে কেন?”
"তোমার ১৪ গুষ্টির ভাগ্য, আমার মতো বউ পেয়েছ!"
এদের স্বামীদের বউয়ের গঞ্জনা শুনতে শুনতে তাকে কিছু বলার ক্ষমতা কমতে কমতে একটা সময় চলেই যায়। খুবই অসহায় এদের জীবন।
৩. হস্তিনী বউ: হস্তিনী বউয়ের হাতি হয়ে ওঠার পেছনে তার স্বাস্থ্যের কোনো সম্পর্ক নেই। এই বউ ঘরে রাখা অনেকটা হাতি পালার মতো। মাসের শুরুতেই সে জামাইয়ের মানিব্যাগটিতে অধিকার স্থাপন করে তা অধিগ্রহণ করবে। খরচের ব্যাপারে সে হিসেবের ধার ধারবে না। মাসের মধ্যে ১৪ বার শপিংয়ে গিয়ে তার ক্ষান্তি নেই। হাতি যেমন গ্রামে হানা দিয়ে বনের ভেতরে শস্য নিয়ে যায়, তেমনি হস্তিনী বউ স্বামীর সংসারের টাকা সুন্দরভাবে বাবার সংসারে মানি লন্ডারিং করে দেবে।
৪. সুন্দরী বউ: এই বউ সুন্দরী এবং এটাই তার সমস্যা। সুন্দরী বউ যদি বিনয়ী হয় তবেও সমস্যা, আর দেমাগী হলে তো কথাই নেই। সুন্দরী বউয়ের রূপের দেমাগ থাকলে পুরো শ্বশুরবাড়ি, বিশেষত ননদ ও জাকুলের সাথে ঠান্ডা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। আর যদি রূপ নিয়ে কোন গর্ব না-ও থাকে, তবুও অকারণে অনেক কথাই শুনতে হয়। পান থেকে চুন খসলেই রূপের কথা তুলে খোঁটা দেয়া হয়:
“হুঁ, সুন্দর বউ ঘরে নিয়ে আসছে। তাকে তো আবার কিছু বলা যাবে না!"
“বউ সুন্দর হলেই হয় না শুধু, সাথে সংসারের কাজকামও কিছু করতে হয়।"
“সারাজীবন কি রূপচর্চা করেই কাটবে?”
“রূপ ধুয়ে কি জল খাবে?” (স্বামীর উদ্দেশ্যে শ্বশুরবাড়ির লোকজন)
৫. চিরযৌবনা বউ: তার বয়স হয়েছে, কিন্তু সৌন্দর্য্যে লেশমাত্র ছাপ পড়েনি। অন্যান্য মহিলারা যেখানে ফুলেফেঁপে উঠছেন, চামড়ায় ভাঁজ পড়ছে, সেখানে চিরযৌবনা বউ দিন দিন শুকাচ্ছেন, আরও সুন্দর হচ্ছেন! জামাইকে নিয়ে কোনো পার্টিতে গেলে লোকে তাদের দেখে বাবা মেয়ে ভাবছে – এমন ঘটনাও ঘটতে দেখা যায়। চিরযৌবনা বউয়ের পরকীয়ার ব্যাপারে জামাইরা সাধু সাবধান!
৬. সন্দেহবাজ বউ: এই বউ শুধু জামাইকে সন্দেহ করে। সে কোথায় যায়, কি করে, কি খায়, কাদের সাথে ওঠাবসা করে সব খবর তার চাই। ৫ মিনিটের জন্য ফোন বিজি পেলেই তার কড়া জিজ্ঞাসা, “কার সাথে কথা বলছিলে?” ফোন দিয়ে সর্বদা স্বামীর খোঁজ খবর নিতে ভালোবাসেন। শার্টের কলারে চুল আর লিপস্টিকের দাগ খোঁজা তার রোজকার অভ্যাস। নিষ্পাপ স্বামীদের এমন বউরা প্রতিবাদী করে তোলেন। স্বামীরা ভাবেন – কিছু না করেই যখন এত কিছু শুনছি, তার চেয়ে ভালো কিছু করে তবে শুনি।
৭. বৌ-মা: এই বউ 'বউ' কম, মা বেশি। সব সময় স্বামীর ওপর একটা গার্জিয়ানগিরি ফলানোর চেষ্টা সে করবে। সারাক্ষণ এটা খাবে না, ওটা ধরবে না, বেশি বুঝো না তো – এসব বলবে এবং স্বামীকে সার্বক্ষণিক শাসনের ভেতরে রাখবে।
৮. নিঃসঙ্গ বউ: এই বউয়ের স্বামী বিয়ে করে তাকে গ্রামের বাড়ি রেখে গেছে বা দেশের বাইরে গেছেন। নিঃসঙ্গ বউয়ের জীবন খুব কষ্টের। স্বামী কবে ফিরবেন – দিন গোনা যেন শেষ হয় না তার! দিনের মধ্যে অসংখ্যবার ক্যালেন্ডার দেখে! জামাইয়ের সাথে কথা বলতে যোগাযোগের কোনো মাধ্যমই বাদ দেন না। অনেক ক্ষেত্রে এমন বউরা প্রতারণার শিকার হন, যখন জামাই শহরে ও বিদেশে আরেকটি বিয়ে করে। অনেকে আবার স্বামীর অপেক্ষা সহ্য করতে না পেরে নিজেই পরকীয়ায় আসক্ত হয়ে যান।
৯. আত্মকেন্দ্রিক বউ: নিজেকে নিয়েই পুরোটা সময় ব্যস্ত থাকেন আত্মকেন্দ্রিক বউ। বাসার রান্নাবান্নার পুরো দায়িত্বটা কাজের মেয়েকে বুঝিয়ে দিয়েছেন, আর ছেলেমেয়ের পড়াশোনা কোচিং সেন্টারকে। অবসর সময়টা কাজে লাগান টিভিতে সিরিয়াল দেখে আর রূপচর্চা করে। যৌথ পরিবারের ক্ষেত্রে বাড়ির অন্য বউদের মতো সংসারের কোনো কাজে কর্মে তার কোনো অংশগ্রহণ থাকে না। এর জন্য যে লোকে তাকে খারাপ ভাবছে তাতেও তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমন বউরা খুব বেশিমাত্রায় বহির্মুখী হন।
১০. হাই স্ট্যাটাস বউ: এই বউ জামাইকে পদে পদে ও হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দেবে সে কোন ফ্যামিলির মেয়ে, সেখানে কি কি হতো, যা তার (স্বামীর) সংসারে হয় না। এই বউ সব সময় জামাইকে বলবে, বাটার ছাড়া কোনো দিন সে সকালে নাস্তা করে নাই, বিয়ের পর সে (স্বামী) যে চাকরিটা পেয়েছেন সেটাও তার বাবার কল্যাণে, ঘরের আসবাবপত্র সবই তার বাপের বাড়ি থেকে আসা ইত্যাদি ইত্যাদি।
১১. হতাশাগ্রস্থ বউ: এই বউয়ের আফসোস আর দুঃখের সীমা নেই। স্বামীর সংসারে এসে সে কিছুই পায়নি। কত শখ ছিলো বিয়ের পর সুইজারল্যান্ড যাবে, প্রতি মাসে একট নতুন শাড়ি হবে, নিজের একটা ফ্ল্যাট হবে, ছেলেমেয়েরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়বে, আরো কত কি! উঠতে বসতে স্বামী বেচারাকে সেইসব হতাশামাখা বাণী শুনতে হয়।
১২. হিংসুটে বউ: হিংসুটে বউয়ের সবকিছুতেই হিংসে, সবার সাথেই হিংসে। এই বউকে তার জামাই আর্থিক বা মানসিকভাবে কোনকালেও সুখী করতে পারবে না। আর বউয়ের নজর শুধু কার বউ ৭০ হাজার টাকা দিয়ে শাড়ি কিনলো, জা ননদরা কে কি করল! সারাদিন শুধু এইসব নিয়েই আলোচনা আর ফিসফাস।
১৩. প্যাঁচালো বউ: এই বউ সংসারে অশান্তি বয়ে আনেন – তার কথাবার্তা, আচার আচরণ, কূটচাল আর কুটনামির স্বভাব দিয়ে। স্বামীর কানে শ্বাশুড়ির নামে বদনাম করেন আর শ্বাশুড়ির সামনে ছেলের। ‘এর কথা ওকে’ আর ‘ওর কথা একে’ বলে বেড়ানো তার স্বভাব। কথা ছড়ানোর সময় দু চার পরত রং মাখাতেও ছাড়েন না প্যাঁচালো বউ।
১৪. পানসে বউ: কোনো কিছুর প্রতিই এই বউয়ের বিশেষ কোন আগ্রহ দেখা যায় না। স্বামী অনেক শখ করে তার জন্য কিছু একটা করলে বা উপহার দিলেও “হ্যাঁ, সুন্দর” ব্যাস এটুকু বলেই শেষ। এই সামগ্রিক আগ্রহের অভাবে শুধু স্বামী নয়, সন্তানদের সাথেও পানসে বউয়ের একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়। তাকে কেউ ঘাঁটায় না, সেও কাউকে ঘাঁটায় না।
১৫. বাপের বাড়ি প্রিয় বউ: বছরের মধ্যে ১০ মাসই এই বউ বাপের বাড়ি থাকেন! কদাচিৎ শ্বশুড়বাড়িতে গিয়ে তাদের কুশলাদি জেনে আসেন। বউয়ের কারণে জামাইকেও অনেকটা সময় শ্বশুরবাড়িতে কাটাতে হয়। সাধারণত নিজের মা বাবার পরামর্শেই তিনি এমনটা করেন।
১৬. ঘরজামাইয়ের বউ: ঘরজামাই যেমন দুর্বলচিত্তের, তার স্ত্রী ঠিক ততোটাই শক্ত ও কড়া মানসিকতার। ঘরের বাজার সদাই থেকে শুরু করে বাচ্চাকে স্কুলে আনা নেওয়া সবই তিনি ঘরজামাইকে দিয়ে করান। আর মুহূর্তে মুহূর্তে মনে করিয়ে দিতে ভোলেন না – এই বাড়িটা কার বাবার!
১৭. সেলিব্রিটির বউ: সেলিব্রিটিদের বউ দু ধরনের হন। যদি বউ নিজেও সেলিব্রিটি হন, তবে স্বামীর সার্বক্ষণিক নারীসঙ্গ তাকে তেমন একটা প্রভাবিত করে না। কারণ তিনি নিজেও পুরুষসঙ্গে আসক্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু বউ যদি সাধারণ হন, তবে এগুলো সহ্য করা খুব কষ্টের হয়ে যায়। স্বামীর বেপরোয়া জীবন নিয়ে কিছু বলার ক্ষমতা কমতে কমতে একটা সময় চলেই যায়।
১৮. কর্মজীবী বউ: কর্মসূত্রে অনেকটা সময়ই বাসার বাইরে থাকতে হয় কর্মজীবী বউকে। আর তাই বাচ্চার দেখভাল সহ সাংসারিক নানা কাজে খুব কমই সময় দিতে পারেন। অধিকাংশ পরিবারেই বিষয়টিকে অত্যন্ত নেগেটিভভাবে নেয়া হয়। স্বামীর সমস্যা না থাকলেও সমস্যা থাকে শ্বশুরবাড়ি থেকে। সেই চাপে অনেক সময় কর্মজীবী বউদের চাকরী ছেড়ে সংসারমুখী হতে হয়। আর শক্ত মানসিকতার অনেকে দীর্ঘদিন লড়াই চালিয়ে হয় জয়ী হন, নতুবা শেষ পন্থা হিসেবে সেপারেশনে চলে যান।
১৯. তিড়িং বিড়িং বউ: এই বউ সবকিছুতেই খুব উৎফুল্ল গোছের। বিয়ের পরে সমাজ যে ধরনের গাম্ভীর্য আশা করে তার অনেক কিছুই এর মধ্যে অনুপস্থিত। সাধারণত কমবয়সী মেয়েরা বউ হয়ে ঘরে এসে তাদের বয়সী কোনো দেবর/ননদ পেলে এমনটা হয়ে থাকে। সাংসারিক রীতি রেওয়াজ বজায় রেখেই চলে বন্ধুসুলভ সম্পর্ক। এমন বউরা বেশ খোলা মন এবং বিস্তৃত চিন্তার অধিকারী হয়ে থাকেন।
২০. ভাবী বউ: এই বউ প্রচলিত ‘ভাবী কালচার’ এর মধ্যে বসবাস করেন। বাচ্চার স্কুল বা কোচিং হোক, পাশের বাসার গৃহিণী হোক কিংবা হোক না কোনো বিয়ের অনুষ্ঠান – ভাবী কালচার চলছে চলবে! কোন ভাবীর জামাই কত হাজার টাকার শাড়ি কিনে দিল, কোন ভাবীর বাচ্চা কয়টা কোচিং করে, কোন সিরিয়ালে কোন নায়ক নায়িকা হাত ধরে কি বলেছে, কার শ্বাশুড়ির আচরণে কি সমস্যা, কার বুয়া কার হাত ধরে ভেগেছে – আলোচনার কি আর শেষ আছে?
২১. কাঁঠালের আঠা/এঁটেল বউ: স্বামী তাকে নির্যাতন করে, মারধর করে, শারীরিক/মানসিক হেন কোনো যন্ত্রণা নেই যা শ্বশুরবাড়ির লোকজন দেয়নি – তবু সন্তানের জন্য বা লোকলজ্জার ভয়ে সংসার ধরে রেখেছেন বা রাখছেন এই বউ। অত্যাচার সইতে না পেরে শতবার বাপের বাড়ি গিয়েছেন, আবার ফিরেছেন। লক্ষ্মী বউয়ের মতই ইনিও এক অর্থে আবহমান বাংলার চিরাচরিত বউ।
সংগৃহীত